বিজ্ঞাপন
সংগ্রামের শুরু: ২০০৩ সালে এসএসসি পাস করার পর পারিবারিক অনীহায় লিজার উচ্চশিক্ষা থেমে যায়। ২০০৭ সালে বিয়ে হলেও স্বামীর মাদকাসক্তি, অবহেলা ও নির্যাতনের কারণে আট বছর পর এক সন্তানকে নিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয় বাবার বাড়ি। সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম।
বাবার বাড়িতে ফিরে লিজা পুরনো পরিচিত সুঁই-সুতার কাজকেই নিজের ভরসা করে নেন। তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিসিক থেকে বাটিক, সেলাই, বিউটিফিকেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শিশুদের জামা তৈরির কাজ শুরু করে দোকানে দোকানে পণ্য সরবরাহ করে ধীরে ধীরে আয় বাড়াতে থাকেন।
‘লিজা বুটিকস হাউজ’: স্বাবলম্বিতার ঠিকানা লিজা নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তাঁর মতো সংগ্রামী নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করেছেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনেরও বেশি নারী কাজ করছেন। এই নারীরা বাড়িতে বসেই পণ্য তৈরি করে লিজার কাছে সরবরাহ করেন।
২০২৩ সালে নেত্রকোণা শহরের শিববাড়ি এলাকায় তিনি 'লিজা বুটিকস হাউজ' নামে একটি সেলস সেন্টার চালু করেন। এখান থেকেই কুঁশিকাটার পোশাক ও হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। লিজার তৈরি পণ্য এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কর্মীদের মুখে স্বস্তির কথা: লিজার সঙ্গে কাজ করা কামরুন্নাহার বাবলী বলেন, "লিজা আপার সঙ্গে কাজ শুরু করার পর আমার জীবন বদলে গেছে। এখন নিজের উপার্জনে সংসার চালাতে পারি, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ দিচ্ছি।" আরেক কর্মী মিনা বেগমের ভাষায়, "অভাবের সংসারে লিজা আপা আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন আমি মাসে কিছু টাকা আয় করি। সংসারে শান্তি ফিরেছে।" বাবলী, মিনা, ডলি, রুণা, কাঞ্চন, শিউলীসহ অর্ধশত নারী লিজার হাত ধরে তাঁদের জীবন বদলে ফেলেছেন।
লিজার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার: আফরোজা আক্তার লিজা বলেন, "স্বামীর সংসারে যখন টিকতে পারিনি, তখন বুঝেছিলাম—নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। ছোটবেলায় শেখা সেলাই-কুশিকাটার কাজই আমার ভরসা হয়। সরকারি দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করি। অন্য নারীদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করি। এখন অনলাইন ও অফলাইনে আমার পণ্য বিক্রি হয়। দেশের বাইরেও যাচ্ছে।"
তিনি শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি বড় শোরুম ও নিজস্ব কারখানা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন এবং এর জন্য সরকারের সহযোগিতা ও সহজ ঋণ প্রত্যাশা করেন।
লিজা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও নারীদের পাশে আছেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, সন্তানদের শিক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে তিনি নিয়মিত কাজ করেন।
জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফারজানা পারভীন লিজাকে "পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত" হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, "লিজা যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। নিজের চেষ্টায় তিনি যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থান দিয়েছেন।"
আজ আফরোজা আক্তার লিজা শুধু একজন সফল উদ্যোক্তা নন, তিনি নারীর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তাঁর হাতে বোনা কুঁশিকাটা এখন সংগ্রাম, সাহস ও সফলতার গল্পে পরিণত হয়েছে।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...