বিজ্ঞাপন
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন সংশোধনীর ফলে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টসহ শীর্ষ আদালতগুলোর পরিচালনা কাঠামোতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। সরকার সমর্থিত মহলের দাবি, এই ব্যবস্থা সশস্ত্র বাহিনীকে কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামো দেবে এবং আদালতে মামলার জট কমাবে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব নতুন কিছু নয়। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস জুড়ে রয়েছে অভ্যুত্থান, সরাসরি ক্ষমতা দখল এবং পর্দার আড়ালে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ঐতিহ্য।
জেনারেল জিয়া-উল-হক এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামল পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট নজির হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বিশ্লেষকরা নানা সময়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোকে ‘হাইব্রিড সিস্টেম’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন—যেখানে বেসামরিক ও সামরিক শাসন পাশাপাশি চলে।
কিন্তু নতুন সংশোধনীর ফলে সেই ভারসাম্য সামরিক বাহিনীর দিকে আরও স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়েছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “এটি সম্ভবত এ পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ইঙ্গিত—পাকিস্তান এখন আর হাইব্রিড সিস্টেম নয়, বরং পোস্ট-হাইব্রিড ব্যবস্থায় প্রবেশ করছে। বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক যতটা অসম হতে পারে, এখন আমরা তেমনটাই দেখছি।”
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালনকারী আসিম মুনির এখন থেকে শুধু সেনাবাহিনী নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীরও তত্ত্বাবধান করবেন। ফিল্ড মার্শাল হিসেবে তার পদবি আজীবনের জন্য বহাল থাকবে, এবং অবসর গ্রহণের পরও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পরামর্শে তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
ফলে ধারণা করা হচ্ছে, আজীবনই তিনি রাষ্ট্রের জনপরিসরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন। সমর্থকদের দাবি, এর ফলে সামরিক কমান্ড কাঠামো আরও সুস্পষ্ট হবে এবং আধুনিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হবে।
সংশোধনীর সবচেয়ে বিতর্কিত দিকগুলোর একটি হলো ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠন। এই আদালত সাংবিধানিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দেবে, এবং এর প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করবেন রাষ্ট্রপতি—সরাসরি নির্বাহী বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কমিশনের সহ-সভাপতি মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেন, “এটি ন্যায্য বিচারের ধারণাকেই বদলে দিল। যখন বেঞ্চ গঠনের ক্ষমতাই নির্বাহী বিভাগের হাতে, তখন একজন সাধারন মামলাকারীর ন্যায়বিচারের আশা কোথায়?”
বিচার বিভাগ স্বাধীনতা হারাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরাও। সাংবাদিক আরিফা নূর বলেন, “বিচার বিভাগ এখন কার্যত নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ—স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনও ক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকবে না।”
নতুন আইনে বিচারকদের তাদের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন আদালতে বদলি করা যাবে, এবং বদলি প্রত্যাখ্যান করলে বিচার বিভাগীয় কমিশনে আপিল করতে হবে। যদি তাদের যুক্তি অবৈধ বলে বিবেচিত হয়, সংশ্লিষ্ট বিচারককে অবসরে পাঠানো হবে।
এই বিধান ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার ভাষায়, “একজন বিচারককে নিজের প্রদেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া মানে তাকে সরকারের ইচ্ছার প্রতি আরও অনুগত হতে বাধ্য করা। এটি বিচার বিভাগের ভারসাম্য নষ্ট করবে।”
সংশোধনী স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি—আথার মিনাল্লাহ ও মনসুর আলী শাহ—পদত্যাগ করেন। বিচারপতি মিনাল্লাহ লিখেছেন, “যে সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, তা আর নেই।”
অন্যদিকে বিচারপতি শাহ অভিযোগ করেন, “২৭তম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।”
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, সংসদ সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, আর বিচারপতিদের পদত্যাগ এসেছে তাদের “একচেটিয়া কর্তৃত্ব” কমে যাওয়ার বিরক্তি থেকে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের আওতায় এনে এবং সামরিক বাহিনীকে বিস্তৃত ক্ষমতা দিয়ে পাকিস্তান কর্তৃত্ববাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাংবাদিক আরিফা নূর সতর্ক করে বলেছেন, “এটি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত।”
মাইকেল কুগেলম্যানও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই উত্তেজনা পাকিস্তানের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য শুভ নয়।
গত বছর পাস হওয়া ২৬তম সংশোধনীতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল। এখন ২৭তম সংশোধনীর সমালোচনা তুঙ্গে, আর ইতোমধ্যে ২৮তম সংশোধনী নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা শুরু হয়েছে।
নতুন আইনের সমর্থকরা দাবি করছেন, এটি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক ও কার্যকর করবে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছেন, এটি এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেবে।
ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোকে কোন পথে নিয়ে যাবে—তা নিয়ে এখন দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক চলছে।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...