Logo Logo
মতামত

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে উলবাকিয়া কি কার্যকর ?


ভোরের বাণী

Splash Image


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রায় প্রতি মৌসুমেই হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, অনেকেই প্রাণ হারান। মশাবাহিত এই ভাইরাসজনিত রোগ দমন করতে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে নতুন ও টেকসই সমাধানের খোঁজে বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই কাজ করছেন। এরই মাঝে আলোচনায় এসেছে একটি সম্ভাবনাময় পদ্ধতি—উলবাকিয়া (Wolbachia) প্রযুক্তি।

উলবাকিয়া একটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া যা বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ পোকামাকড়ে দেখা যায়। এই ব্যাকটেরিয়া মানবদেহের জন্য নিরীহ হলেও মশার প্রজননক্ষমতা ও ডেঙ্গু ভাইরাস বহনে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, উলবাকিয়া-আক্রান্ত এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে না। এতে মশার সংখ্যা ও ডেঙ্গু সংক্রমণ উভয়ই কমে আসে।

এই প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে তা সুনির্দিষ্ট। প্রথমে ল্যাবরেটরিতে বিশেষভাবে প্রজনন করিয়ে উলবাকিয়া-আক্রান্ত পুরুষ এডিস মশা তৈরি করা হয়। তারপর এসব বন্ধ্যা পুরুষ মশাকে নিয়মিতভাবে ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকাগুলোতে মুক্ত করা হয়। স্ত্রী মশার সঙ্গে এদের সঙ্গমে ডিম থেকে লার্ভা তৈরি হয় না, ফলে মশার সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেমন সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার ইয়োগিয়াকার্তায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ৭৭ শতাংশ কমেছে। তবে ঢাকার মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ, দূষিত ও অপরিকল্পিত শহরে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

ঢাকার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ—যেমন অতিরিক্ত মশার ঘনত্ব, নির্মাণাধীন স্থানে পানি জমে থাকা, এবং ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত মশার জীবিত থাকার হার কমে যাওয়া—এই প্রযুক্তির কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উপরন্তু, স্থানীয় মশার জিনগত বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা স্ত্রী মশার পছন্দও প্রযুক্তির সাফল্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিটির সফল বাস্তবায়নে প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল। এর মধ্যে রয়েছে:

জনগণকে সচেতন করে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা

পরিবেশবান্ধব লার্ভিসাইডের ব্যবহার

কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি

স্মার্ট নজরদারি ও ট্র্যাকিং প্রযুক্তির ব্যবহার

সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ

এছাড়া প্রযুক্তিটির প্রাথমিক প্রভাব মূল্যায়নের জন্য ঢাকার মিরপুর বা গুলশানের মতো সু-সংজ্ঞায়িত এলাকায় পাইলটিং করা যেতে পারে। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে শহরব্যাপী বিস্তার ঘটানো হবে টেকসই পরিকল্পনার অংশ।

তবে এই পুরো প্রক্রিয়ার আগে জরুরি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ এবং গবেষকদের পরামর্শ। বিদেশ থেকে মশা আমদানির পরিবর্তে দেশে উলবাকিয়া প্রযুক্তিতে মশা তৈরি করে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং প্রভাব মূল্যায়নই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ কি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুন যুগে প্রবেশ করবে, নাকি বাস্তবতার কঠিন দেয়ালে আঘাত খাবে—সে উত্তর ভবিষ্যতের হাতে।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

professorkabirul@gmail.com

আরও পড়ুন

ত্রাণ মজুত, তবুও নেই সহায়তা : ঝড়-বৃষ্টিতে ভাঙা ঘরে বৃদ্ধ দম্পতির মানবেতর জীবন-যাপন
ত্রাণ মজুত, তবুও নেই সহায়তা : ঝড়-বৃষ্টিতে ভাঙা ঘরে বৃদ্ধ দম্পতির মানবেতর জীবন-যাপন
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক ব্যক্তি ও সমাজ, ঈদুল আজহায় এনসিপির শুভেচ্ছা বার্তা
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক ব্যক্তি ও সমাজ, ঈদুল আজহায় এনসিপির শুভেচ্ছা বার্তা