Logo Logo

প্রথম আলোর প্রতিবেদন

পাথরের পর এবার বালু : হুমকির মুখে সিলেটের প্রাকৃতিক ভারসাম্য


Splash Image

সিলেটের শ্রীপুর, রাংপানি, জাফলং, সংরক্ষিত বাংকার এলাকা থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন নদ-নদী ও পর্যটনকেন্দ্রে চলছে নির্বিচার বালু লুট। পাথরের মতোই এই বালু লুটের কারণে অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা স্থানগুলো ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে পড়ছে।


বিজ্ঞাপন


স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা চক্র প্রকাশ্যে বালু তুলছে। মাঝে মাঝে প্রশাসন অভিযান চালালেও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

১৯৯২ সাল থেকে শ্রীপুরকে পাথর কোয়ারি আখ্যা দিয়ে ইজারা দেয় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। ২০১৩ সালে গেজেটভুক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে হারাতে থাকে শ্রীপুরের প্রাকৃতিক রূপ। ২০২০ সালে ইজারা বন্ধ হলেও অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়েছে। আগে গোপনে লুট হলেও এখন তা প্রকাশ্যে চলছে।

শ্রীপুর ও রাংপানি এলাকার টিলাসদৃশ বালুর স্তূপ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। নদী ও চর থেকে বেলচা-কোদাল দিয়ে নির্বিচারে বালু খোঁড়ায় জনপদ রূপ নিয়েছে বিরানভূমিতে।

গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকায় নদীর দুই পাড়জুড়ে নোঙর করা থাকে অসংখ্য নৌকা ও বাল্কহেড। এখান থেকে অবিরাম বালু তোলা ও সরবরাহ হয় বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শুধু জাফলং এলাকা থেকেই প্রায় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছে।

অভিযানের ভয়ে আপাতত সরাসরি তোলা কম হলেও সম্প্রতি জাফলং চা-বাগানসংলগ্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক মানুষকে বালু তুলতে দেখা গেছে। একইভাবে বড়গাং নদের লালাখাল অংশে ইজারাভুক্ত এলাকার বাইরেও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে।

সিলেটে ৪০টি বালুমহালের মধ্যে ইজারাযোগ্য ২০টির মধ্যে ১৫টি ইতিমধ্যে প্রায় ২৭ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। তবে ইজারার বাইরের জায়গা থেকেও বালু লুট অব্যাহত রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলীয় নেতারা বালু-পাথর মহালের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর আগে নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীরব ঐক্যের ভিত্তিতেই এ লুট চলছে।

অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল আহাদ, সহসভাপতি আলমগীর হোসেন, স্থানীয় জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম ও যুবদল নেতা দিলদার হোসেন। আওয়ামী লীগ আমলে এ লুটে নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ওরফে রাজা, যিনি বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন।

যদিও অভিযুক্ত নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছেন, তারা দীর্ঘদিন পাথর-বালুর ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেট-এর সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে পাথরের পাশাপাশি বালু লুটও শুরু হয়। প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। নামকাওয়াস্তে অভিযান চালানো হলেও প্রকৃতিবিনাশী এ অপকর্ম থামেনি।”

তিনি আরও বলেন, কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বালু উত্তোলনের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর ফলে বেশির ভাগ এলাকা থেকে পাথরের মতো বালুও গণলুট হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলোর ধারণা, গত এক বছরে সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদী ও পর্যটনকেন্দ্র থেকে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ঘনফুট বালু পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “অন্যায্যভাবে বালু-পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর লুটপাট অনেকটাই থেমেছে।” তবে প্রশাসনের কাছেও কতটুকু বালু লুট হয়েছে—সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।

শ্রীপুর, রাংপানি, জাফলং, লালাখালসহ সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো একসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু নির্বিচার বালু ও পাথর লুটে আজ সেসব জনপদ হয়ে পড়েছে শ্রীহীন। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতি রক্ষায় এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে আগামী প্রজন্ম এ সৌন্দর্যের আর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে না।

বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

আরো দেখুন


বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...