প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। ফাইল ছবি
বিজ্ঞাপন
সেই অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত রূপ ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট, যখন ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তিন দিন সরকারশূন্য থাকার পর, ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। আজ ৮ আগস্ট—‘বদলে যাওয়া’ বাংলাদেশের সেই সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো।
এই এক বছরে সরকারের সাফল্য, ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে রাজনৈতিক মহল, সুশীল সমাজ ও বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি:
গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছিল। ‘মব জাস্টিস’-এর মতো অরাজকতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পুরোপুরি কাটেনি, যদিও জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় বিএনপি স্বস্তি প্রকাশ করেছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামী মনে করছে, সরকার বড় দলকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং গণহত্যার বিচার ও সংস্কার ইস্যুকে পেছনে ফেলে নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার হার আগের মতোই রয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। হত্যাসহ সহিংস অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও সরকার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক মূল্যায়ন এসেছে। যেমন- ব্যাংক খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা ইত্যাদি। রাজনৈতিক নেতারা একে সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থপাচার রোধও প্রশংসিত হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:
বিএনপি
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পর ভঙ্গুর অবস্থায় দায়িত্ব নেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা ছিল। আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনে অস্থিরতা কাটেনি।”
সেলিমা রহমানের মতে, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি উদ্বেগজনক, অর্থনৈতিক সাফল্য সীমিত।”
জামায়াতে ইসলামী
নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “কিছু বড় ইস্যু সরকার ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে।” সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ জানান, “সংস্কার কার্যক্রমে ঐকমত্য হয়েছে, তবে গণহত্যার বিচার কতদূর যাবে তা সময় বলবে।”
গণসংহতি আন্দোলন
প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “মানুষের নিরাপত্তা, শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি ও আহতদের দায়ভার নেওয়ায় সরকার সন্তোষজনক স্থানে পৌঁছাতে পারেনি।”
এনসিপি
সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “অভ্যুত্থান-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা কিছুটা উন্নত হলেও রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে বড় পরিবর্তন আসেনি। তবে বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা না থাকাকে ইতিবাচক ধরা যায়।”
অর্জন:
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি বড় অর্জন হলো—রাষ্ট্রীয় সংস্কারে ডান-বাম রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে আনা। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ ও ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে বাস্তবায়ন ও আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে।
সামনের চ্যালেঞ্জ:
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। রাজনৈতিক দলগুলো এ ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও সামনে বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো— সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, ‘জুলাই সনদ’-এর আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন, জুলাই গণহত্যার বিচার কার্যক্রম দৃশ্যমান করা, শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রমকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া, ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা ইত্যাদি।
সংক্ষেপে, এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বস্তি আনতে সক্ষম হলেও আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে—গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সংস্কার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন।
জনপ্রিয়
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...