বিজ্ঞাপন
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ফেরা ট্রলারভর্তি ঝলমলে রুপালি ইলিশ নামানো হয় আড়তে, সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠে হাঁকডাক, দর হাঁসাহাঁসি আর নিলামের প্রতিযোগিতা। ক্রেতা, পাইকার ও শ্রমিকের কণ্ঠে মিশে যায় সমুদ্রের লোনা গন্ধ। সকাল গড়ানোর আগেই লাখ লাখ টাকার মাছ হাতবদল হয়। তবে বাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে এই ইলিশের দাম চলে যায় সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে।
সূর্য ওঠার মুহূর্তেই বন্দরে শুরু হয় ব্যস্ততা। প্রথমেই ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে করা হয় আড়তগুলো। এরপর ট্রলার থেকে নামানো হয় ইলিশ। সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যেই নিলামস্থল ভরে ওঠে শত শত পাইকারে। সম্প্রতি ‘এফবি আল্লাহর দোয়া’ নামের একটি ট্রলার ৬১ মণ ইলিশ নিয়ে বন্দরে ফেরে। আড়ত ‘খান ফিস’-এ সেই মাছ বিক্রি হয় ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭০৪ টাকায়। বড় সাইজের (৯০০–১০০০ গ্রাম) ইলিশ মণপ্রতি ৭৩ হাজার, মাঝারি (৬০০–৮০০ গ্রাম) ৫৮ হাজার এবং ছোট (৪০০–৫০০ গ্রাম) ৪৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
নিলাম শেষে শুরু হয় প্যাকেজিং প্রক্রিয়া। ধোঁয়া বরফে সংরক্ষণ শেষে ট্রাকে তোলা হয় ইলিশ। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। পরিবহন ও মধ্যবর্তী ধাপের অতিরিক্ত খরচ যুক্ত হওয়ায় বাজারে গিয়ে দাম আরও বেড়ে যায়, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
প্রতিদিন আলিপুর বন্দরে কয়েক শত শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করেন। অথচ কয়েক কিলোমিটার দূরে মহিপুরে সরকার-নির্মিত আধুনিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র কার্যত অচল। ২০১২ সালে পরিকল্পনা, ২০১৬ সালে নির্মাণ সমাপ্তি এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের পরও সেখানে ব্যবসা জমেনি। মাত্র ৪০ জনের জন্য জায়গা ও ২০টি ট্রলারের ধারণক্ষমতা থাকায়, ৮২ জন ব্যবসায়ী, ২ হাজারের বেশি ট্রলার, ২০০ জন পাইকার ও ৮০০ শ্রমিকের চাপ সামলানো সম্ভব হয় না।
ফলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী নিজস্ব ঘাটে মাছ বিক্রি করছেন, এতে সরকার প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে আলিপুর ও মহিপুর মিলিয়ে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের লোকসান দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মহিপুর কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে আধুনিকায়ন এবং নিলাম প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজ করলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে ও বাজারে কিছুটা হলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
আলিপুর বন্দরের এই ভোরবেলার কর্মযজ্ঞ কেবল শ্রমিক ও পাইকারদের জীবিকার গল্প নয়; এটি দেশের জাতীয় মাছ ইলিশের দাম, প্রাপ্যতা ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার বাস্তবতাও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। সাগরের ঢেউ পেরিয়ে বন্দরে ভিড়তে থাকা রুপালি স্বপ্ন অনেকের জন্যই আজ কেবল দূর থেকে দেখার বিলাসিতা।
প্রতিবেদক - জাকারিয়া জাহিদ, কলাপাড়া, পটুয়াখালী।
জনপ্রিয়
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...