Logo Logo

শামুক কুড়িয়ে জীবন চলে তাদের


Splash Image

ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে ওঠেন তারা। হাতে পুরোনো বস্তা, ব্যাগ, সঙ্গে থাকে কাঠের বৈঠা আর ছোট্ট নৌকা। তারপর নৌকায় চড়ে ছুটে যান বগনালের বিলের গভীরে—যেখানে কাদার নিচে লুকিয়ে আছে তাদের জীবিকার অবলম্বন, জলজ শামুক। দিনভর পানিতে ডুব দিয়ে শত শত শামুক তোলেন তারা। বস্তা ভরলে নৌকা ঠেলে তীরে এনে রেখে আবার ফিরে যান বিলে। সন্ধ্যা নামলে সেই শামুক বিক্রি করে যে টাকা পান, তাতেই চলে তাদের সংসার।


বিজ্ঞাপন


এ গল্প মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের অনেক পরিবারের। জীবিকার সন্ধানে প্রতিদিনই তারা ছুটে যান খাল-বিলে।

বরইচারা গ্রামের বাসিন্দা নিতাই সরকার জানান, সামান্য কিছু জমি আছে, কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই প্রতিদিন বগনালের বিল থেকে শামুক কুড়িয়ে পার্শ্ববর্তী জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘দিনে এক থেকে দেড় বস্তা শামুক কুড়িয়ে বিক্রি করলে তিনশ টাকার মতো পাই। ওই টাকাতেই ছেলে মনিগের পড়াশোনা আর সংসারের খরচ চালাই।’

একই জীবিকার সঙ্গী ষাটোর্ধ্ব কমলা রানী বিশ্বাসও। তিনি বগনাল বিল ও নরপতির খালের আশপাশে শামুক কুড়িয়ে সংসার চালান। চার মেয়ে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার।

কমলা রানী বলেন, ‘শামুক কুড়িয়ে যা পাই, তা দিয়েই খাই, মেয়েদের লেখাপড়া করাই। কখনো শাপলা বিক্রি করি, কখনো মাছ ধরি, আবার কখনো পরের বাড়িতে কাজ করি। জীবন কষ্টের, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দয়ায় এখনো বেঁচে আছি।’

স্থানীয়রা জানান, শামুক ধরার কাজ চলে সারা বছরজুড়ে—বর্ষা হোক বা শুষ্ক মৌসুম। কাদামাটির নিচে বা পানির গভীরে লুকিয়ে থাকা শামুক হাত দিয়ে বা লাঠির সাহায্যে তোলেন তারা। পরে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এক বস্তা শামুক বিক্রি হয় প্রায় তিনশ টাকায়, মৌসুম অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে।

এই শামুক মূলত কেনেন মাছ ও হাঁসের খাদ্য ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কিছু শামুক যায় চুন তৈরির কারখানায়, যেখানে খোলস পুড়িয়ে তৈরি হয় চুন। একসময় অকাজের বলে অবহেলিত এই জলজ প্রাণীই এখন বহু দরিদ্র পরিবারের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন।

তবে এই পেশা যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক কষ্টসাধ্য। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পানিতে ভিজে থাকতে হয়। রোদ-বৃষ্টি বা ঠান্ডা—কোনো কিছুই তাদের কাজ থামাতে পারে না। অনেক সময় কাদার নিচে লুকিয়ে থাকা সাপ, কেঁচো বা ধারালো লোহার টুকরোয় আহত হন তারা। তবু সংসারের তাগিদে, সন্তানের মুখের হাসির জন্য প্রতিদিনই ফিরে যান সেই একই বিলে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ তালের ডোঙায়, কেউবা টিনের নৌকায় করে ছুটছেন বিলের ভেতরে। কোমরসমান পানিতে দাঁড়িয়ে একে একে কুড়িয়ে নিচ্ছেন শামুক।

শামুকের মতোই তাদের জীবন নিঃশব্দ, তবু দৃঢ়। জলাশয়ের শামুক এখন শুধু নদী-খালের প্রাণ নয়, বহু দরিদ্র মানুষের জীবিকার ভরসা হয়ে উঠেছে। শালিখার খাল-বিলের এই শামুক সংগ্রহ শুধু জীবিকারই গল্প নয়, বরং এটি অনেক পরিবারের টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।

স্থানীয় শামুক ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতি বস্তা শামুক ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় ক্রয় করা হয়। পরে পরিবহন ব্যয়সহ এসব শামুক ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে প্রতি বস্তা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সংগৃহীত শামুকগুলো একসঙ্গে পিকআপ ভ্যানে করে ঢাকায় পাঠানো হয়।’

শালিখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ‘শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। এতে অনেক পুষ্টিগুণ আছে। মাছ ও হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতির ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরা প্রকৃতি থেকে যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য সরকার ও সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ এখন অত্যন্ত জরুরি।’

বগনালের বিলে শামুক সংগ্রহ আজ শুধু জীবিকার নয়—এটি টিকে থাকার সংগ্রাম, প্রান্তিক মানুষের অবিচল সাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

আরো দেখুন


বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...