Logo Logo
ফিচার

বেকারত্ব থেকে ব্র্যান্ডের মালিকানা : যে গল্পে জীবন বদলেছেন ফাতেমা ও ইয়াসমিন


ভোরের বাণী

Splash Image


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজারো নারী এখনো বেকারত্ব, সংসার আর আত্মসম্মানের টানাপড়েনে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেন। তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা প্রতিকূলতার মাঝেও নতুন পথ খুঁজে নেন। যশোরের দুই নারী ফাতেমা আজাদ ও ইয়াসমিন সুলতানা তাদেরই প্রতিনিধি—যাঁরা প্রথাগত ব্যর্থতার গল্পকে পাল্টে লিখেছেন নতুন সফলতার ইতিহাস।

যশোর সদর উপজেলার লাউজানি গ্রামের মেয়ে ফাতেমা আজাদ। বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন, তাই পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন ভালোভাবেই। যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আশায় ছিলেন সরকারি চাকরি, স্বাবলম্বী হওয়ার। কিন্তু একের পর এক ব্যর্থতায় জীবন আটকে যায়।

“সব জায়গায় আবেদন করতাম, সিভি দিতাম—কেউ একটা ইন্টারভিউতেও ডাকতো না। একসময় মনে হলো, হয়তো আমি যোগ্যই নই,” বলছিলেন ফাতেমা।

চূড়ান্ত হতাশায় একদিন তিনি তার শিক্ষাগত সনদ ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হন। ঠিক সেই সময় স্বামী জাকির হোসেন তাকে বলেন, “সনদ ছিঁড়লে কিছু হবে না। তোমার যা আছে, তা দিয়েই শুরু করো।”

সেই কথা থেকেই নতুন যাত্রা। ফাতেমা ছোটবেলা থেকেই রান্না ভালোবাসতেন। শুরু করলেন হোম কিচেন থেকে বিরিয়ানি সরবরাহ। মাত্র ১,২০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তৈরি করলেন ১২ প্যাকেট বিরিয়ানি। সেগুলো বিক্রি করে পেলেন আত্মবিশ্বাস।

এখন তার প্রতিষ্ঠান "আলোর সঞ্চয় এগ্রো ফুড অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার" থেকে মাসে গড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করেন। তার উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় রয়েছে ড্রাই ফুড, প্যাকেট খাবার, আচার, পিঠা, হালিম মিক্স প্রভৃতি। ফাতেমা শুধু নিজেই নয়, ২০-২৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণও দেন নিয়মিত।

প্রতিষ্ঠানটিকে রেজিস্ট্রেশন ও ট্রেড লাইসেন্স করেও নিয়মিত আয়কর দিচ্ছেন। পেয়েছেন ‘জয়িতা পুরস্কার’, জেলা প্রশাসনের ‘উদ্যোক্তা সম্মাননা’ এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশংসাপত্র।

ইয়াসমিন সুলতানার বেড়ে ওঠা তুলনামূলক স্বচ্ছল পরিবারে। স্বপ্ন ছিল বিচারক হওয়ার, বাবাও ছিলেন সহায়ক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হঠাৎ বাবার মৃত্যু, বিয়ে এবং দ্রুত মা হওয়ার ফলে সব বদলে যায়।

স্বামী এবং সন্তানদের যত্ন নিতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেন ইয়াসমিন। চাকরি বা আদালতের জীবন আর হয়নি। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি।

“আমি বুঝলাম, স্বপ্ন পাল্টে গেলে জীবনের মানে পাল্টে যায় না,” বলেন ইয়াসমিন।

২০২৩ সালে যশোর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নারীনির্ভর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেখানে শিখেছেন খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও অনলাইন বিপণন। সেখান থেকেই শুরু হয় তার উদ্যোগ “নান্দনিক ফুড অ্যান্ড এগ্রো”।

বর্তমানে ইয়াসমিন নিজের হাতে তৈরি করছেন ঘরে তৈরি গুড়া মসলা, বিটরুট পাউডার, কুমড়োর বড়ি, ড্রাই ফ্রুটস মিক্স, হালিম মিক্স ও ভেষজ চা। ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি অর্ডার পাচ্ছেন, মাসে আয় করছেন ২০-২৫ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, “নারী মানেই শুধু ত্যাগ নয়, তৈরি করাও। আমি সেটা বিশ্বাস করি এবং অন্য নারীদের সেই বিশ্বাস শেখাতে চাই।”

এই দুই নারীর সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে সরকারি সহায়তা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম) এবং ড্যানিশ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ‘পার্টনার’-এর যৌথ প্রকল্প ‘সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার, ফুড অ্যান্ড ফিড ফেয়ার মার্কেটিং অ্যাকসেস’ প্রকল্পের মাধ্যমে তারা পেয়েছেন ‘অন দ্য জব ট্রেনিং’।

প্রকল্পের আওতায় নারীরা পেয়েছেন কাঁচামাল সংগ্রহ, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজারে প্রবেশ, ভোক্তা সচেতনতা, কর ও লাইসেন্স ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ। ২০২৮ সাল পর্যন্ত চলবে এই প্রকল্প, যেখানে হাজারো নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

কৃষি বিপণন কর্মকর্তা কিশোর কুমার সাহা বলেন, “ফাতেমা বা ইয়াসমিনের মতো নারীরা আসলে সমাজে নতুন ধারণার জন্ম দিচ্ছেন—নারী শুধু ভোক্তা নয়, তারা উদ্যোক্তাও।”

বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজারো নারী হেরে যান সমাজ ও বাস্তবতার সাথে লড়াইয়ে। কিন্তু ফাতেমা আজাদ ও ইয়াসমিন সুলতানার গল্প প্রমাণ করে, পরিবর্তন সম্ভব—যদি থাকে ইচ্ছা, সংকল্প এবং সহায়তা।

তারা এখন আর চাকরিপ্রার্থী নন—তারা নিজেরাই চাকরিদাতা, প্রশিক্ষক ও নেতৃত্বের প্রতীক।

আরও পড়ুন

ত্রাণ মজুত, তবুও নেই সহায়তা : ঝড়-বৃষ্টিতে ভাঙা ঘরে বৃদ্ধ দম্পতির মানবেতর জীবন-যাপন
ত্রাণ মজুত, তবুও নেই সহায়তা : ঝড়-বৃষ্টিতে ভাঙা ঘরে বৃদ্ধ দম্পতির মানবেতর জীবন-যাপন
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক ব্যক্তি ও সমাজ, ঈদুল আজহায় এনসিপির শুভেচ্ছা বার্তা
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক ব্যক্তি ও সমাজ, ঈদুল আজহায় এনসিপির শুভেচ্ছা বার্তা