ভোরের বাণী
মা সালেহা বেগমের সঙ্গে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে লেখক।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারে লুকিয়ে থাকে এমন কিছু গল্প, যা শুধুই কোনো স্মৃতিচারণ নয়—বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, এক বিস্ময়কর যাত্রার দলিল। এমনই এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প উঠে এসেছে সালেহা বেগম নামের এক সংগ্রামী মায়ের জীবন থেকে। যিনি শুধু আট সন্তানের মা নন, বরং এক অনন্য অনুপ্রেরণা, এক জীবন্ত শিক্ষালয়।
স্মৃতিময় এক বিকেলের কথা দিয়ে শুরু হয় এই গল্প—সৈকতে দাঁড়িয়ে, সূর্যাস্তের দিকে অপলক চেয়ে থাকা মা সালেহা বেগম। ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে অনুভব করছেন, কীভাবে তার মায়ের মুখে সেই আলো যেন সময়কে থমকে দেয়। সে মুহূর্ত আজও তার হৃদয়ে অমলিন।
সালেহা বেগম, নানাবাড়িতে সবার আদরের 'সালু'। কুমিল্লার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম, বাবা ফজলুর রহমান প্রধানের ছোট ও প্রিয় কন্যা। প্রেম আর সম্মানের সঙ্গে তার বিয়ে হয় হাজি জব্বার আলীর নাতি আবদুল গণির সঙ্গে। তবে সেই বিয়ের গল্প কেবল সুখের ছিল না, ছিল বিসর্জন, ভাঙাগড়ার দীর্ঘ অধ্যায়।
আবদুল গণি ছিলেন একাধারে এন্ট্রাস পাস, অন্যদিকে ছন্নছাড়া প্রকৃতির। নানা রকম চেষ্টাতেও সংসারে স্থিতি আনতে পারেননি। জীবনের নানা পর্বে কখনো খাগড়াছড়ি, কখনো সুনামগঞ্জ—ভবিষ্যতের আশায় পাড়ি জমাতে গিয়ে পরিবারকে ফেলেছিলেন গভীর সংকটে।
১৯৮১ সালে কুমিল্লা ছেড়ে পরিবার নিয়ে সুনামগঞ্জ চলে আসেন। জমি কেনা হলেও প্রতারণা আর হুমকির জালে তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। শুরু হয় দারিদ্র্যের নির্মম জীবন। সালেহা বেগম—যিনি আগে অভাব চিনতেন না—হঠাৎই নিজেকে খুঁজে পান খাদ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিদিন লড়াই করা এক মায়ের ভূমিকায়।
তবে এখানেই থেমে থাকেনি গল্প। তিনি ছিলেন একজন নীরব যোদ্ধা। দিনের শেষে সন্তানদের পাতে খাবার তুলে দেওয়া, রাতে হারিকেনের আলোয় পড়ালেখার পরিবেশ তৈরি করা—সবই একার হাতে সামলেছেন তিনি। বড় চার ভাইয়েরা আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে শিক্ষাজীবন বিসর্জন দিলেও, ছোট চার ভাই ও একমাত্র বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন।
এই সন্তানরাই আজ দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা—সবাই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তাদের সফলতার মূলে একটিই নাম—সালেহা বেগম।
বাবা প্রয়াত হয়েছেন বহু আগেই। কিন্তু মায়ের ছায়া এখনো মাথার উপর। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সীমাহীন ত্যাগ আর সুশৃঙ্খল সংগ্রাম আমাদের শিক্ষা দেয়—একজন মা পারেন ইতিহাস লিখে দিতে।
লেখক: চিকিৎসক, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল