আবুল হায়াত, ছবি: সংগৃহীত।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের বর্ষীয়ান অভিনেতা ও সাহিত্যিক আবুল হায়াত এক সময় তীব্র ধূমপানের অভ্যাসে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ধূমপানের সূচনা ঘটে তাঁর ছাত্রজীবনে, যখন তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বর্তমানে বুয়েট) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিজের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’-এ তিনি লিখেছেন, কিভাবে ছাত্রাবস্থায় হলের ছোট একটি দোকান থেকে সিগারেট কেনা শুরু করে ধীরে ধীরে তা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়।
তিনি উল্লেখ করেছেন, “হলের দোকানে বাকি খাতায় নাম লেখালাম। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে চারটি ক্যাপস্টান সিগারেট খাওয়া যেন রুটিন হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করলাম একজন পূর্ণমাত্রার ধূমপায়ী হিসেবে।”
পেশাগত দায়িত্ব ও রাতদিনের কর্মব্যস্ততায় ধীরে ধীরে এই অভ্যাস আরও পোক্ত হয়ে ওঠে। অভিনয়, নাটক পরিচালনা, প্রকৌশল প্রকল্প কিংবা গণমাধ্যম—যেখানেই তিনি যুক্ত ছিলেন, সিগারেট যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে। চাপ সামলাতে কিংবা জাগরণে সঙ্গী হতো চা ও ধোঁয়ার ধারা।
তিনি বলেছেন, “ব্যস্ততা, উদ্বেগ, ক্লান্তি—সব কিছুর মাঝে সিগারেট যেন ছিল একমাত্র আশ্রয়।”
তিন বছর লিবিয়ায় চাকরি শেষে দেশে ফিরে আবারও অভিনয়ে সক্রিয় হন তিনি। এ সময় দেশে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনতা বাড়তে শুরু করে। তিনিও ধূমপান ত্যাগ করতে চাইলেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। মনে মনে চেষ্টা করতেন, কিন্তু মাঝেমধ্যে না চাইলেও আবার তা শুরু হয়ে যেত।
এই টানাপড়েনের সময় একদিন ঘটে যায় একটি ঘটনাবলী, যা তাঁর জীবনের দিক পাল্টে দেয়।
একদিন তাঁর ছোট মেয়ে নাতাশা স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে সিগারেট টানতে দেখে। সে কাছে এসে সিগারেটটি কেড়ে নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলে, “তুমি এটা খাবে না। আপা বলেছে, তুমি সিগারেট খেলে সেই ধোঁয়ার ক্ষতি আমাদেরও হতে পারে। এতে আমাদের মৃত্যুও হতে পারে। তুমি কি সত্যিই আমাদের মারা যেতে চাও?”
মেয়ের এই নিষ্পাপ প্রশ্নে এক বাবার হৃদয় কেঁপে ওঠে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এবার ধূমপান চিরতরে ছেড়ে দেবেন।
তবে দীর্ঘদিনের আসক্তি হুট করে কেটে যায় না। দিনে ছেড়ে রাতে ধরতেন, আবার রাতে ছাড়লেও সকালে ফিরে যেতেন সেই পুরোনো অভ্যাসে।
একদিন হঠাৎ একটি বিদেশি ম্যাগাজিনে চোখ পড়ে তাঁর। সেখানে একজন মনোচিকিৎসকের লেখা ছিল ‘ধূমপান ত্যাগের সহজ পদ্ধতি’ বিষয়ে। লেখাটির একটি বাক্য ছিল—“ধূমপান ছাড়াটা কঠিন নয়। আপনি প্রতিদিন একাধিকবার ছাড়ার চেষ্টা করেন বলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু সফল হতে চাইলে একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট—Just don’t smoke.”
এই একটি বাক্য যেন তাঁর ভেতরে আলো জ্বেলে দেয়। সময়টা ১৯৯২ সালের জানুয়ারি। সামনে ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি—তাঁর ও স্ত্রীর বিবাহবার্ষিকী। তিনি সেই দিনটিকেই বেছে নিলেন ধূমপানমুক্ত জীবনের সূচনার জন্য।
৩ ফেব্রুয়ারির রাতে স্ত্রীকে একটি নতুন সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার দিয়ে বললেন, “এই হলো তোমার উপহার। আজ থেকে আমি আর কখনো ধূমপানে জড়াব না।”
সেই দিন থেকেই তিনি আর কখনো সিগারেট স্পর্শ করেননি।
একটি শিশুর সরল প্রশ্ন, এক মনোবিজ্ঞানীর চিন্তাজাগানিয়া পরামর্শ এবং নিজের ভেতরের শক্ত মানসিক প্রস্তুতি—এই তিনের সম্মিলনে আবুল হায়াত জয় করেন বহু বছরের একটি ক্ষতিকর অভ্যাসকে। তাঁর এই যাত্রা কেবল সিগারেট ত্যাগের গল্প নয়, এটি এক জীবনের পুনর্জন্ম, যা আজও অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
-নিউজ ডেস্ক