ভোরের বাণী
বিজ্ঞাপন
এই সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন ছয়জন উপাচার্য, যাদের মধ্যে তিনজনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু উপাচার্য বদলালেও বদলায়নি ববির দুরবস্থা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, আবাসন ও শিক্ষকদের সংখ্যা। বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্থায়ী সেশনজট, অবকাঠামো সংকট ও প্রশাসনিক অস্থিরতার এক জটিল আবহে বন্দি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে আছে মাত্র দুটি একাডেমিক ভবন এবং মাত্র ৩৬টি শ্রেণিকক্ষ। ২৫টি বিভাগের প্রায় ১৫০টি ব্যাচের ক্লাস চালাতে হচ্ছে ১৬৭ জন শিক্ষককে, যাদের অনেকেই আবার শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য আছে দুটি করে আবাসিক হল, যেখানে আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। নেই অডিটোরিয়াম, আধুনিক গবেষণাগার, মানসম্পন্ন গ্রন্থাগার বা পর্যাপ্ত অফিসকক্ষ। এমন এক শোচনীয় পরিস্থিতিতে দিন দিন শিক্ষার্থীদের হতাশা বাড়ছে।
অনেক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তাদের মতে, শিক্ষকরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ব্যবহার করেন নিজেদের স্বার্থে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পরে পদ-পদবি পাওয়াই হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য। একজন শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকরা সৎ ও শিক্ষার্থীবান্ধব না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সংকট কাটবে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিরতার ছায়ায় ঢাকা। সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিন শিক্ষার্থীদের টানা ২৯ দিনের আন্দোলনের মুখে অপসারিত হন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। এর আগে ৩য় উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের সময়েও শিক্ষক-কর্মকর্তা দ্বন্দ্ব থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রূপ নেয় বেশ কয়েকবার। সবচেয়ে বেশি আন্দোলনের মুখে পড়েন ২য় উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। তার সময়ে দুই দফায় আন্দোলনে একবার ১৫ দিন এবং পরেরবার ৪৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হারুন অর রশিদ খান ও ৩য় উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিলেন।
মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির রহমান বলেন, “চৌদ্দ বছর পার হলেও অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। কখনও গাদাগাদি করে, আবার কখনও খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করতে হয়। হলে জায়গা না পেয়ে অনেকে উচ্চ ভাড়ায় বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।”
অপর শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ এনামুল বলেন, “গুটিকয়েক শিক্ষকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই করুণ অবস্থা। তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক তথ্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সরবরাহ করে পদ-পদবি নিশ্চিত করেন। এর ফলে শিক্ষক মহলে মাফিয়াতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে।”
সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সুজয় শুভ বলেন, “চিন্তা-ভাবনা এবং অবকাঠামোর দিক থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এখনও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। বারবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও রাজনীতির ফাঁদে পড়ে ভিসিরা পথভ্রষ্ট হয়েছেন।”
পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান আহসানুল হক বলেন, “মাত্র দুজন শিক্ষক মিলে ৬-৭টি ব্যাচের ক্লাস চালাতে হচ্ছে। একজন শিক্ষককে গড়ে ১৮-২০টি কোর্স পড়াতে হয়। এতে করে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।”
জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাফিজ আশরাফুল বলেন, “শিক্ষকদের মধ্যে পদ-পদবির জন্য দুইটি গ্রুপে বিভাজন দেখা গেছে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রশাসনিক পদ বাগিয়ে নিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যার ফলে সার্বিক অস্থিরতা তৈরি হয়।”
নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, “শিক্ষার্থীরাই আমাদের মূল শক্তি। আমি সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করি এবং আগামীতেও সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে চাই। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনো সমস্যাই দুর্ভেদ্য থাকে না। বুদ্ধিমত্তা ও সদিচ্ছা থাকলে সমাধান অবশ্যই সম্ভব।
প্রতিবেদক-মো. আশিকুল ইসলাম, বরিশাল।